সূর্য ধিরে ধিরে রক্তিম আভা ছড়াতে লাগলো। বন সবুজ থেকে গাড় সবুজ এরপর কালো হতে থাকে। পানিতে লাল আভার প্রতিবিম্ব। অপার্থিব এক দৃশ্য। এ সময়টায় আমার ভীষন মন খারাপ হয়। আমার পরিবার কে আমি ভীশন মিস করি। ভ্রমনের প্রতিটা সন্ধ্যা কাটে
অদ্ভুত মন খারাপ নিয়ে।
রাত ৮ টায় আমরা পৌছালাম হীরন পয়েন্টে। ট্রলার নোঙর করা হলো ফরেষ্ট অফিসের অনেকটা আগে। কিছুক্ষণের মাঝেই আকাশে চাঁদের দেখা পেলাম। লাল টক টকে চাঁদকে সাথে নিয়েই শুরু হলো রাতের খাবার। হঠাৎ তমজিদ ভাই বললো বাঘ গর্জন করছে। আমরা সাথে সাথে চুপ হয়ে গেলাম। চারদিকে অসহ্য রকম নিরবতা। পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দটাই মনে হচ্ছে অনেক শব্দ। দূর থেকে একটা বন মোরগ ডেকে উঠলো সারা বন কাঁপিয়ে। বাঘের গর্জন আমরা আর শুনতে পেলাম না।
রাতে সামসুজ্জামান ভাই সি সিকনেসে পরলেন। কয়েকবার বমি করলেন। দুকূল ভাসানো গৃহত্যাগী জোছনা তার উপভোগ করা তার হলোনা। এরকম জোছনায় ভাসা আর কখনো হবে কিনা জানিনা। হীম হীম ঠান্ডায় জোৎস্নার আলোতেই স্লীপীং ব্যাগে ঢুকে গেলাম। প্রকৃতির কোলে কখন ঘুমিয়ে পরেছি জানিনা।
পানির কলকল শব্দে ঘুম ভাংলো। চোখ মেলতেই সবুজের দেয়াল। সুজন ঘোষনা দিলো। আমরা এখন হীরন পয়েন্ট ঘুরতে যাব। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নিন। আমরা দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলাম। এতোদিন যেই ফলক টা শুধু ছবিতে দেখেছি আজ সেই ফলকের সামনে। আমরা সবাই ছবি তুলতে লাগলাম। হীরন পয়েন্ট পুকুরপাড়ে যেতেই দেখি ৩/৪ টা হরিণ পানি খাচ্ছে। সে এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। পুকুর পাড়ের গাছ গুলির প্রতিবিম্ব মাঝে হরিণ গুলির পানি খাওয়া। বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে এই দৃশ্য কি আর আমরা দেখবো। এটা হয়তো শুধু স্মৃতি হয়েই থাকবে। ওয়াচ টাওয়ারে উঠে পুরো এলাকা দেখার মজা পাওয়ার আগেই খেয়াল হলো সেটা প্রবলভাবে নড়ছে। ভয়েই নেমে গেলাম। ছোট একটা ডোবার মতো জায়গা দেখলাম একটা পাইপ বসানো। সেখান থেকে পানি বের হচ্ছে। আর লাইটার ধরলেই আগুন ধরলেই আগুন ধরে যায়। আরেকটা জায়গায় ফরেস্টের লোকেরা চুলাই বানিয়ে ফেলেছে। প্রতিনিয়ত আগুন জ্বলে সেখান থেকে এবং সেখানে রান্না-বান্নাও হয়। তার মানে সুন্দরবনের নিচে ভালোই গ্যাস আছে।
নদীর উল্টো পাশেই দেখলাম নৌকাতে মাছ বাছাই চলছে। হরেক রকম মাছ। দাম করতেই আমাদের এক বেলার খাবার মতো মাছ ফ্রীতেই দিয়ে দিলো। তারমধ্যে এক থালা টাইগার চিংড়ি ছিল।
ট্রলারে ফিরে ডিম ভাজি আর খিচূড়ি দিয়ে নাস্তা করে ৯:৩০ এ রওয়ানা করলাম আরাধ্য পুতনীর দ্বীপের উদ্দ্যেশে। আবারও ছুটে চলা। সাগর শান্ত হলেও বাতাস ছিল। খুব বেশিক্ষণ লাগলো না দ্বীপে পৌছাতে। দ্বীপে প্রথম পা ফেলার অনুভূতি অন্যরকম হলো। আমার আগে কোন পায়ের চিহ্ন নেই। মনে হচ্ছিল আমিই প্রথম। কোলাহলহীন পরিস্কার, শান্ত একটা বিচ। জোয়ারের পানি তখনো নেমে যায়নি। পানি নেমে যেতেই যে বিচ বের হলো তা দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না । আরো একবার মনে হলো পাহাড়ের থেকে আমাকে সমুদ্রই বেশি টানে। তার টানেই নেমে পড়লাম অবগাহনে। সবাই ঝাপাজাপি করতে করতে এতই ভালো লাগলো যে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা আর মান্দার বাড়ী যাব না আমরা এখানেই থাকবো। এখানেই হবে আমাদের ক্যাম্পিং। স্নান শেষে আমরা আবার ট্রলারে ফিরলাম। খাওয়া দাওয়া করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। এরপর তাবু স্লীপিং ব্যাগ নিয়ে নেমে পরলাম ট্রলার থেকে। ক্যাম্প সাইট আগেই দেখে রেখে ছিলাম। ৭ টা তাবু ফেলার জন্য ভীষণ উপযুক্ত যায়গা। আরিফ নূর ভাই সি সিকিনেসের জন্য ট্রলারেই থেকে গেলো। আমরা দশজন নেমে পরলাম। আমাদের এই বিকেলটা হয়তো সারাজীবন মনে থাকবে। দুইদিন শুয়ে বসে থেকে কিছুটা হাপিয়েই গিয়েছিলাম। তাবু খাটাতে খাটাতেই সূর্যমামা লুকানো শুরু করলো। অসাধারন এক সূর্যাস্ত দেখলাম। বনের ভীতর থেকে সমুদ্রে সূর্যাস্ত অসাধারন এক দৃশ্য।
অন্ধকার নামতেই আগুন জ্বালানো হলো। প্রতিটা তাবুতে আলো জ্বলে উঠলো। গল্পে মেতে উঠলাম সবাই। সুজন ঘোষনা দিলো এর আগে কেউ সুন্দরবনে ক্যাম্পিং করেনি। আমরাই প্রথম এই পদক্ষেপ নিলাম। প্রথম কোন কিছু করার মধ্যে ভীষণ এক আনন্দ আছে। আমারা উদ্বেলিত। ভীষণ এক বিপদ সংকুল জায়গায় আমরা ক্যাম্পিং করেছি। বেশ রোমাঞ্চকর ছিল পুরো ব্যাপারটা।
আমাদের ক্যাম্পিং এর পরের অংশটা ছিল আরো রোমাঞ্চকর এবং ভীতিকর। জলদস্যুদের তাড়া খাওয়া, অন্ধকারে কাদার মদ্ধ্যে আতংকিত হয়ে হাটা। সে গল্প না হয় আরেকদিন করা যাবে। আপাতত সুখ স্মৃতিটুকু থাক। বিশেষভাবে ধন্যবাদ দিতে চাই আমাদের ফরেস্টের দুজন গার্ড কে। তাদের সাহসিকতা বুদ্ধিমত্তায় আসলেই আমরা মুগ্ধ। আর ধন্যবাদ আমার সাথের ১০ জন সঙ্গীকে।
-ঠাকুর বিলাস